চিত্তি চাকমা

লংগদু গণহত্যা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
চিত্তি চাকমা

পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে সেই বৃটিশ আমল থেকে। এখানে পাহাড়িদের দুঃখ-বেদনা, হাসি-কান্না প্রত্যকে একে অপরের সাথে জড়িয়ে আছে। কিন্তু কিছু শাসক গোষ্টি সেখানে পাহাড়িদের জবরদস্ত করে আসছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের থেকে। তাই শাসক গোষ্টির থেকে কিছুটা মুক্তি পাওয়ার জন্য বিদ্রোহ করে আসছিল জুম্ম জণগোষ্টি। কিন্তু দূর্ভাগ্য আজও শান্তি ফিরে পায়নি। ১৯৯৭ এর ২রা ডিসেম্বর বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের সাথে জণসংহতি সমিতির শান্তি চুক্তি হয়। ভাবতে শুরু করলো এবার হয়তো কিছুটা হলেও শান্তি ফিরে আসবে। শাসক গোষ্টির জিম্মির হাত থেকে মুক্তি পাবো। কিন্তু দীর্ঘ এগার বছরে শান্তি চুক্তি পা রাখলো এই পর্যন্ত কোন সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিকতা দেখায়নি। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের জীবন বৈচিত্র সম্পর্কে স্ব চোখে না দেখলে বুঝার কোন উপায় নেই শাসক গোষ্টির হাতে এখনও জিম্মি।

বিগত নব্বই শতকের আগে সামরিক বাহিনী পার্বত্য এলাকাতে সন্ত্রাস দমন নামে চালিয়েছিল পাহাড়িদের উপর নির্যাতন, ধর্ষন, গণহত্যা। এর মধ্যে লোগাং, নানিয়ারচর এবং লংগদু গণহত্যা বিশেষ উলে খ্য। সামান্য এক গ্রাম্য কোন্দলকে উপলক্ষ করে সামরিক বাহিনী ও বাঙালী সেটেলারের লোকজন কেরোসিন দিয়ে আগুন ধরায় লোগাং গ্রামে। সেনা বাহিনীরা গুলি চালায় আর সেটেলাররা কসাইয়ের মত কুপিয়ে জবাই করে নিরপরাধ পাহাড়িদের উপর। একই ভাবে নানিয়ারচর হাট-বাজারে পাহাড়িদের উপর গণহত্যা চালায় সেনাবাহিনীরা। এর পরে একই ভাবে একই কায়দায় লংগদু গণহত্যা চালানো হয়। তারপরে লংগদু এবং বাঘাইছড়ি উপজেলার মাঝামাঝি স্থানে মাইল্যা ইউনিয়নে লঞ্চ ডুবি ঘটনাকে কেন্দ্র করে গণহত্যা চালানো হয়। কিন্তু এসব ঘটনা দেশে বিদেশে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশ করলেও বাংলাদেশ সরকারের কোন তনক পড়েনি। এবং তার ধারে কাছেও যায়নি।

১৯৮৯ এর ৪ঠা মে লংগদু গণহত্যা হয়েছিল। এর কযেকজন প্রাণে বেঁচে যাওয়া লোকজনের কাছ থেকে ঘটনার বর্ণনা শুনলে গা শিউরে উঠে। যাকে যখন যেভাবে পেয়েছে সেখানে হত্যা করেছিল। প্রাণে বেঁচে যাওয়া লোকের সামনে থেকে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা করা হয় নিস্পাপ শিশু আর শিশুটির মাকে করেছিল ধর্ষণ। এভাবে নিরপরাধ পাহাড়িদের কতজনকে হত্যা করেছিল তার কোন হিসাব এখনো পায়নি। এর প্রত্যেকটি ঘটনার মূল মদত দাতা ছিল সেনাবাহিনী আর তাদের লেলিয়ে দেওয়া পোষা বাঙালি সেটেলাররা কসাই এর মত কুপিয়ে হত্যা করে। হত্যা করেও শান্তি পায়নি চালিয়েছিল লুটপাট, পুড়িয়ে দিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম শত শত ঘর বাড়ি। প্রাণে বাঁচার জন্য পাহাড়িরা আরও পাহাড়ের ভিতর যখন আশ্রয় নিয়েছিল এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সেটেলার বাঙালিরা সেনাবাহিনীর মদতে পাহাড়িদের পূর্ব পুরুষের ভিটে মাটিতে বসত বাড়ি গড়ে তুলে। পরে ফিরে এসে সেসব জায়গা আর ফিরে পায়নি। এভাবে জবর দখল করে কতজনের জায়গা বাঙালি সেটেলাররা বসত বাড়ি গড়ে তুলেছে তার কোন ইয়াত্তা নেই।

লংগদু উপজেলার প্রাক্তন চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুল রশিদ সরকার বলা যায় সেটেলারদের একজন গডফাদার। তাকে সেদিন কে বা কারা হত্যা করেছিল। এই হত্যার জের ধরে পরের দিন সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে চলে গণহত্যা। সেই দিন সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনের উচিৎ ছিল মূল হত্যা কারীকে সনাক্ত করে আইনানুগ ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্ত তারা সেথা না করে চালিয়েছিল নিরপরাধ পাহাড়িদের উপর নির্যাতন, ধর্ষন এবং পরে গণহত্যা।

এই ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী কিছু সেটেলারদের সনাক্ত করেছিল। যারা ঘর বাড়ি লুট করে আজ সেই সব সম্পত্তি নিয়ে সচ্চল ভাবে জীবন চালিয়ে যাচ্ছে। আর ওরা প্রকাশ্য ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার কেউ কেউ সরকারি, আধা-সরকারি চাকুরিতে বর্তমানে নিযুক্ত রয়েছে। বর্তমানে দূর্নীতির দায়ে সাজা প্রাপ্ত সেটেলারদের গডফাদার আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া নেতৃত্বে তথা কথিত “সমঅধিকার আন্দোলন”, সামপ্রদায়িক ও উগ্র জাতীয়বাদি সংগঠনে লংগদু উপজেলার কিছু বাঙালি সেটেলার যুক্ত। যারা সংগঠনে জড়িয়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত হয়ে জবর দখল করে নিয়ে যাচ্ছে পাহাড়িদের পূর্ব পুরুষের ভিটে মাটি। তিন পার্বত্য জেলায় চলছে ঐসব সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। আর গণহত্যার পৃষ্টপোষকতায় যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া বর্তমান সরকারের নৈতিক দায়িত্ব।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যাবে তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলায় পাহাড়িদের চেয়ে বাঙালি সেটেলারের সংখ্যা বেশী।

This entry was posted in প্রবন্ধ ও গল্প. Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান